অন্ধকারের আলো




    অন্ধকারের আলো   
  



আমরা যে শহরটাতে থাকি, সেখান থেকে প্রায় ৩ কি.মি. দূরে একটি স্কুল আছে। স্কুলটির নাম- জামালপুর এইচ বি হাই স্কুল। আমরা সকলে জানি এইচ বি ইংরেজী শব্দ। সেই স্কুলের নাম কেনই বা জামালপুর হাইস্কুল হলো সেটা আমরা কখনই ভেবে দেখেনি। তবে একদিন নলা খবর নিয়ে এলো যে আসলে এইচ বি শব্দটা রাখা হয়েছে পুরোনো আমলের বাদশার ঘোড়ার নাম অনুসারে। সেই বাদশার ঘোড়া নাকি অনেক দামি খাটি ছিলো। সে স্কুলের  কর্তৃপক্ষ মনে করেন একদিন ঐ বাদশার ঘোড়া যেভাবে নামকরণ হয়েছে তেমনি নাকি তাদের স্কুলের নামও নামি দামি হবে। এই নিয়া আমরা আর বেশী মাথা ঘামাই নি। তবে এই স্কুলের ছেলেমেয়েদের চালচলন ও আচার আচরণ দেখলে অবশ্য মনে হয় তাদের স্কুল বুঝি এখনই বিখ্যাত হয়ে গেছে। এই স্কুলের ছেলেমেয়েদের অবশ্য রাস্তা ঘাটে তেমন দেখা যায় না। একেকজন যেভাবে পড়া লেখা করে মনে হয় বড় হয়ে কেউ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার না হয়ে থাকতে পারবে না। আমার ধারণা এটা......। জামালপুরের এই স্কুলটা গ্রাম্য শহরে পরার পরও এই গ্রাম্য শহরের যত বড় সড় নেতা ছাতা আছে সবার ছেলে, মেয়ে, নাতি, পুতি এই স্কুলে পড়ে। এইচ বি হাই স্কুলের ছেলে মেয়েরা যেহেতু সবাই বড়লোকের ছেলেমেয়ে তাদের চেহারায় তার স্পষ্ট ছাপ আছে।  এইচ বি হাই স্কুলের ছেলে মেয়েদের সাথে অবশ্য আমাদের কখনও সরাসরি কথা বা সাক্ষাৎ হই নি। তবে একটা জিনিস ভালো করে বুঝতে পেরেছি। তাদের মনে শুধু অহংকার আর অহংকার। তাদের সাথে আমাদের সরাসরি কথা হইনি কিন্তু আমি তাদের নিজেদের মাঝে কথা বলতে শুনেছি। মনে হয় তারা একে অপরকে দেখতেই পারে না। নাই কোনো বন্ধুত্ব তাদের মধ্যে।  বেশীরভাগ ক্ষেত্রে তারা ইংরেজীতেই কথা বলে থাকে। ওদের উচ্চারণ শুনলে আমি না হেসে থেকে পারি না। টমেটোকে বলে টমাটো, আবার কি করো কে বলে কি কোড়ো। আসলে বলতে গেলে অদ্ভূত টাইপের তারা। 


বোঝাই যাচ্ছে, আমাদের এই ছেলেগুলিকে দেখে কিছুটা হিংসা হয়। তারা যে নিজেদের কি মনে করে। আমরা কখনই বোঝতে দেই না তাদের। চোখের আড়াল হয়ে দেখলেও আমরা ভান করি যে তাদেরকে আমরা দেখিই না। 

এখন আসা যাক, আমাদের স্কুলের কথা। আমাদের স্কুল ঠিক তাদের উলটো। এইচ বি হাই স্কুলের সব কিছু যেমন হাই ফাই, তেমনি আমাদের স্কুল হলো ল্যাটফ্যাট। যেমন আমাদের স্কুলের নাম হচ্ছে নাগিনপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়। স্কুলের যে অবস্থা এ থেকে আমাদের স্কুলের নাম হওয়া উচিত ছিলো হাগিনপাড়া নিম্ন বিদ্যালয়!!! নাগিন নামটা আমরা অনেকে জানি। বাংলাদেশ বনাম শ্রীলংকার ম্যাচে শ্রীলঙ্কাদের হারিয়ে বাংলাদেশের টিম যে বিখ্যাত মারকা মাড়া ড্যান্স দিয়েছিলো সেই থেকে আমার এই নামটা মনে পড়ল। হা হা!! আমি তা বোঝাই নি। আমাদের স্কুলের হেড মিস - উনার নাম নাগিন। যেমন তার চেহারা, আচার - আচরণ তেমন রাগী। উনার নামে স্কুলটা খুললে আরোও ভালো হতো। কারণ, উনার মত কিপটা এবং পাজী আমার জীবনে কখনও দেখিনি। পড়াশোনার নাম করে স্কুল চালিয়ে যায়। সপ্তাহে আমাদের বলতে মোট্মাট মিলে তিনটা কি ছয়টা ক্লাস হয়। শুধু তাই না!! এই শহর তার নামে, মাদ্রাসা তার নামে, এমনকি উনার নামে একটা বড় সর মার্কেটও আছে। এই শহরের সবচেয়ে যেটা ভয়ংকর সেটা হচ্ছে উনার নামে দৈনিক পত্রিকা- দেনিক নাগিন। তার যত খারাপ মন্দ হাবি যাবি যা আছে সেই পত্রিকাতে পাওয়া যাবে। 



আমাদের স্কুলের আলাদা করে কোনো পোশাক আশাক নেই। যে যার মত করে পোশাক পড়ে আসে। নলা দাবি করে একটা নাকি পোশাক আছে। আকাশী কালার শার্ট এবং নীল পায়জামা। তবে এখন পর্যন্ত সেটা কেউ প্রমাণ করতে পারে নাই। 


পরদিন সকালে আমি, নলা, ফারা আর নোহাশ মিলে স্কুলের গেটের পাশে চটপটি আর ফোচকা খাচ্ছিলাম। এমন সময় বড় গাড়ি করে কারা যেন এলো। আমি নলার দিকে তাকিয়া বললাম, কিরে! আমাদের স্কুলের মধ্যে আর গাড়ি হতে পারে এটা!
নলা হা করে তাকিয়ে রইল। ফারা এর মধ্যে বলে উঠল-
-জিওন! দেখ দেখ! গাড়িটা কিন্তু আমাদের স্কুলের পার্কিং ওয়েতেই দাড়িয়েছে।
-হ্যাঁ, তাইতো। ব্যাপারটা কি! নাগিন ম্যাম তাহলে!!!!!!!
নোহাশ এর ফাঁকে বলে উঠলো, 
-আরে! গাড়ি থেকে আমাদের বয়সি একটা ছেলে নেমে আমাদের এদিকেই এগিয়ে আসছে।
আমি চমকে বললাম! জামাটা চিনা চিনা লাগতেছে। হুবহু স্কুল ড্রেসের মতো!
নলা বলে উঠল- আরে! এটা থো আমাদের স্কুলেরই ড্রেস। এই প্রথম কাউকে পড়ে আসতে দেখলাম।
ততক্ষণে ছেলেটা আমার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল,
-আচ্ছা! ক্লাস টেনের রোমটা কোন দিকে?
আমি কিছু বলে উঠার আগেই ফারা বলে উঠল,
-তুমি কেরে ভাই! দেখলাম, দুইজন মুরব্বির সাথে গাড়ি থেকে নামলে!
-ওরা আমার বাবা-মা। ক্লাস-টেনটা কোনদিকে?
-চিন্তা করো না! আমরাও ক্লাস টেনে। কি বোঝে এই স্কুলে এলে?
ছেলেটা কিছু না বলেই চলে গেলো।
আমার মধ্যে কেমন যেনো ঘটকা লাগলো। আমি ফারা, নোহাশ আর নলার দিকে তাকিয়ে বললাম,
-যে ছেলেটার এইচ বি হাই স্কুলে পড়ার কথা, সে এখানে কি করে?
ফারা বলল- কিছু তো একটা ঝামেলা আছেই।
- চল! বেশী দেরি না করে ক্লাসে চলে যাই। সেখানেই কথা হবে ওর সাথে।


রুমের ভিতরে গিয়ে দেখলাম ছেলেটা শেষ বেঞ্চে একা একা বসে আছে। কি যেনো ভাবছে মনে হল। আজকে যেহেতু বৃহস্পতিবার! তাই আজ কোনো স্যার আসবেন না। আমাদের স্কুলের সিডিওল আমরা বুঝেই গেছি। আমরা তার চার পাশে ঘেরাও করে বসলাম।
ওকে কিছু বোঝে উঠার আগেই বলে উঠলাম-
-আচ্ছা! গেটের সামনে তোমাকে ফারা জিজ্ঞাসা করলো, "তুমি কে?
আর কি ভেবেই এখানে আসলে?" তুমি কিছু না বলেই যে চলে আসলে? আমাদের এইখানে এমনিতেও কোনো ক্লাস বা পড়া লেখা হয় না।
(ছেলেটা চুপ করে থাকলো এবারো)
-ভয় পেয়ো না। আজ থেকে আমরাই তোমার বন্ধু। মন খুলে তোমার সব কথা আমাদের সাথে শেয়ার করতে পারো।
ছেলেটার চোখে পানি এসে পড়ে। কাদু কাদু গলায় বলতে লাগলো-
-আমি নাফিস। এইচ বি হাই স্কুলেই পড়তাম। আমি ল্যাবটেরি থেকে ক্যামিকেল সংগ্রহ করে বাসায় নিয়ে গিয়েছিলাম। সেটা আবার আমার এক ক্লাস মেট দেখে ফেলেছিলো। আমার নতুন নতুন এক্সপেরিমেন্ট করতে খুবই ভালো লাগে। আমাদের ঐ স্কুলে কেউ কাউকে দেখতে পারে না। আজ যখন তোমরা বললে, তোমরাই আমার বন্ধু! সত্যি খুব ভালো লাগলো। ল্যাবটেরি থেকে যে ক্যামিকেল নিয়ে গিয়েছিলাম সেইটা আমার ক্লাসমেট হ্যাড স্যারকে বলে দেয়। পরদিন যখন স্কুলে যাই!!!!!!!!
নাফিস চুপ করে যায়।
বাকিটা ততক্ষণে আমরা সবাই বুঝে যাই। এইচ বি হাইস্কুলে নাকি অনেক কড়াকড়ি রোলস। তাকে যে সাসপেন্ড করেছে সেটা আমাদের বুঝতে দেড়ি হলো না। ও আবার আমার দিকে তাকিয়ে বললো!
-আচ্ছা! তোমাদের স্কুলে কি ল্যাবটেরি আছে?
-হ্যা, আছে। কিন্তু সেটা ল্যাবটরি রোম নামেই খ্যাত। আদোও কিছু আছে বলে মনে হয় না। আর আমাদের্ব তেমন জানা নেই কিছু।
-আচ্ছা বোঝলাম।
-(একটু হেসে) আমাদের এখানে কিন্তু সহজে সাসপেন্ড করে না।

আমি হঠ্যাৎ খেয়াল করলাম, নাফিস তার পেন্টের পকেটে কী যেনো লুকিয়ে রেখেছে। বারবার সে পেন্টের পকেটে হাত দিয়ে কি যেনো লরচর করাচ্ছে। আমি বলে উঠলাম-

-তোমার পেন্টের পকেটে কি?
- (কিছুটা থমকে) কই কিছু না তো।

আমি মাথা না ঘামিয়ে বললাম, তা আমাদের স্কুলে তো স্কুল ড্রেস পড়ে আসতে হয় না। 

নাফিস আমারা কথার গুরুত্ব না দিয়ে বলল, হুম।
এর মাঝে ফারা  বলে উঠে, 
- তোমার পকেটে ওইটা কি? আমি আর জিওন খেয়াল করেছি। লুকিও না। বলে ফেলো। 
কিছুটা মাথা নিচু করে নাফিস বলে উঠল, প্রোমিস করো! কাউকে বলবে না। তোমাদের আর আমার মাঝেই যেনো থাকে।
আমরা অতি আগ্রহে এক সাথে বলে উঠলাম, হ্যাঁ, প্রোমিস প্রোমিস। এবার বলো।
-এইটা আমি আমার বাসার ঠিক পিছনের দিকটাতে যে জংগল আছে  সেইখান থেকে পেয়েছি। আমি প্রায়ই সময় জঙ্গলের দিকটাতে যাই, যখন খুব খারাপ লাগে। 
আমি বলে উঠলাম-  তোমার বাবা-মা কিছু বলেন না? জঙ্গলের ঐখানে যাও যে!
- না, আমার সাথে আমার বাবা- মা থাকেন না। উনারা শহরে থাকেন। 
- তোমার খুজ খবর নেন না তারা?
- তারা জানেই আমার খুজ নিতে হয় না। আমি একাই থাকতে পারি।
- (কিছুটা হেসে) তুমি পুরাই অদ্ভুত। 
- হাহা! জানি জানি। আচ্ছা তোমরা তো স্কুলের হোস্টেলেই থাকো। তো বলছি যে! আমার সাথে তোমরা থাকতে পারো। আমার তোমাদের অনেক ভালো লাগলো।
- সত্যি বলছো! আমরা থাকতে পারবো!
-হ্যাঁ। তোমরা চাইলে থাকতে পারো। 
আমি ফারা, নুহাশ ওদের দিকে তাকিয়ে বললাম, তোরা কি বলিশ!
- ভালোই হয়। স্কুলের হোস্টেলে থাকতে থাকতে বোর্ড হইয়ে গেছি।
নাফিস অনেকটা খুশি হইয়ে বললো, সত্যি থাকবে তোমরা আমার সাথে?
আমি বললাম- হ্যাঁ রে ভাই। আজ থেকে আমরা সবাই তোমার সাথেই থাকবো। আর আজ থেকে আর তুমি তুমি না, তুই করে বলবো আমরা একে আরেকজনকে! ঠিকাছে?
-হ্যাঁ, অবশ্যই।
ফারা কিছুটা নিচু গলায় বললো!- আমার জন্য আলাদা একটা রোম দিবে?
- হা হা। তোর জন্য সলিড একটা রোম দিবো। চিন্তা করিস না।

এর ফাঁকে রহিম চাচা বলে গেলো- বাচ্চারা, নাগিন ম্যাম বলে পাঠালো, তোমরা যে যার ঘরে বা বাসায় চলে যাও। আজ কোনো স্যার ম্যাডাম আহে নাই।
নাফিস ভেবাচেকা হইয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, স্যার আসবে না!!
- তুই আমাদের স্কুলে স্যারের চিন্তা করিস? হাহা। হাসাইলি।
হ্যাহ! এইখানে সত্যি এতো শান্তি!! 
নাফিস উপরের দিকে তাকিয়ে বললো, বাবা- মা, থ্যাংক্স। 
চল, তহলে আমার বাসায়। সেখানে গিয়ে তোদের আমার এই পকেটের রহস্যটা বলবো..................
                               
                                                                                    (চলবে)




    


                                                                                                                                                                                                         
                                                                                                


You Can Follow:



Facebook:









Youtube










DailyMotion











If you have any complaints, let me know in the comments.

No comments

Theme images by follow777. Powered by Blogger.